মাছ ধরা

ছোটবেলা থেকে মাছের প্রতি আমার দুর্বলতা। সিলেটের মৌলভীবাজারে যাওয়ার পর শুরু হলো আমার মাছ ধরার নেশা। সে যে কী ভীষন নেশা যারা মাছ না ধরেছে তারা সেটা বুঝতেই পারবেনা। সিলেটে তখন হাওড়, বাওড়, বিলের কল্যানে মাছে ভরপুর ছিলো। সে তুলনায় সব্জী ছিলো খুব সীমিত।  “মৎস মারিবো খাইবো সুখে” এ বাক্য সুদুর প্রবাদ হয়েই ছিল আমার জীবনে। মাছ ধরে সুখে খাওয়ার কথা মনে নেই, কিন্তু আম্মার পিটুনির কথা ঠিকই মনে আছে। মাটি খুঁড়ে কেঁচো গেঁথে মাছ ধরায় উনার ছিলো প্রচন্ড ঘেন্না। তাই আমার ধরে আনা মাছ উনি গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন। কেঁচো ছাড়াই আটারগুলি আর ভাত দিয়েই দিব্বি পুঁটি মাছ ধরা যেত। টিপটিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বড়শি দিয়ে পুঁটি মাছ ধরতেম। বর্ষার পুঁটির সাজের কী বাহার! যেন কনে বৌটি! লাল ডুরে শাড়ি পড়া। পড়ন্ত বেলায় স্কুল থেকে ফিরে গোসলখানায় ঢুকে জানালা দিয়ে পালিয়ে পুকুর পাড়ে যেতাম। বাথরুমের জানালায় কোন শিক ছিলোনা। বাইরে থেকে ভারে করে জল চৌবাচ্চায় ঢেলে দেয়া হত। এই জন্যই সেটা এমন উন্মুক্ত ছিলো। পড়ন্ত বেলায় পুকুরঘাট থাকতো নিরিবিলি। সেই সুযোগে ছোট্ট গামছাখানি দিয়ে ঝাঁকবেধে চলা চ্যালা মাছের পালে হামলে পড়তুম। গামছায় ছেঁকে তুলতুম চ্যালা মাছ। নিরিহ মাছগুলো ঝাঁকবেধে চলতো। শিকারীর চোখে সে কালো সরু সরু ঝাঁক ঠিকই নজরে পড়তো। মাঝে মাঝে দু/একটা মাছ কাত হলেই তাদের রুপোর পাতের মত চকচকে শরীর ঝলকে উঠত। বন্দী হত শিকারির জালে, থুক্কু গামছায়। সে মাছ আর ঘরে আনার চিন্তা করতাম না।  মাছগুলো ঘরে নিয়ে গেলে আমার কর্মকান্ড ফাঁস নিয়ে প্রথমেই যে আগুন জলবে ক্রমশ তা অবেলায় ছোট মাছ নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানোর কোনো কারন খুঁজে না পেয়ে আমার পিঠে উত্তম-মধ্যম জোটার আশংকায়আশে পাশের বাসার কাউকে মাছগুলো দিয়ে পুকুরে বেশ করে কয়েকটি ডুব দিয়ে আবার গুটি গুটি পায়ে সেই গোসলখানার জানালা দিয়ে ঢুকে পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতাম।

বৃষ্টি-মুখর ছুটির দিনগুলোতে মাথা কচুপাতা্য ঢেকে ছিপে মাছ ধরতাম। কি কারনে যেন বৃষ্টির সময় টপাটপ মাছ পড়তো বরশিতে। ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি, শোল, ফলি, শিং, মাগুর, কঁই। পাশে রাখা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি ভরে উঠলে ঘরে ফিরে আসতাম। মধ্যবিত্ত মা কিন্তু মাছ দেখে তখন খুশিই হতেন। ট্যাংরা, পুঁটি ছাড়া বাকিগুলো মাটির মটকায় জল ভরে জিইয়ে রাখতেন মা। মাঝে মাঝে আমার বয়সি আরো কিছু সংগী জুটিয়ে অন্য পাড়ার পুকুরেও মাছ ধরতে যেতাম। ছেড়া মশারীর টুকরো দিয়েও মাছ ধরতাম। তাতে অবশ্য শুধুই ছোট মাছ ধরা পড়তো। কাচকি, চ্যালা, চাপিলা। এছাড়া পুকুরে কচুরিপানার ঝাকের নিচে আটকে থাকা কঁই মাছ ধরার স্মৃতিও মনে পড়ে।  সিলেটে শীতের শুরুতে হতো মাছ ধরার উৎসব। তারই একটা পোলো উৎসব।  নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর (ছোট ছোট কম গভীরতার নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর-বাওর) পানি শুকিয়ে হাটু বা কোমর পর্যন্ত নেমে গেলে মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী পলো উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। পলো মূলতঃ বাঁশের কাঠি ও এক ধরনের চিকন জংলি লতা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার উপকরণ। তবে বর্তমান সময়ে সেসব লতা সহজপ্রাপ্য না হওয়ায় চিকন তার বা লাইলনের সূতা দিয়ে বাঁশের তৈরি কাঠি বিশেষ কায়দায় বেঁধে পলো তৈরি করা হয়। কাঁচের পানপাত্র উল্টে রাখলে যেমন দেখায় পলো দেখতে ঠিক অনুরূপ। পলো বাওয়া মূলতঃ এলাকার অনেক লোক একত্রিত হয়ে দল বেঁধে গ্রামীণ ও প্রাচীন মাছ ধরার উপকরণ পলো (বাঁশের তৈরি এক ধরনের খাঁচা আকৃতির) দিয়ে শত শত লোকের একদিক থেকে সারি বেঁধে চিৎকার করে ডাক ভাংতে ভাংতে মাছ ধরা। সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলে সকলে সামনের দিকে ডাক ভেঙে আগ্রসর হওয়ায় মাছগুলো পেছনের দিকে যেতে না পেরে সারিবদ্ধ লোকদের সামনে দিয়ে লাফালাফি করতে করতে পেছনের দিকে ছুটতে থাকে। এ সুযোগে শিকারীরা বড় বড় মাছগুলো লক্ষ্য করে তাদের পলো নিক্ষেপ করে। কোন মাছ পলোতে আটকা গেলে মাছটি পলোর ভেতর লাফালাফি করতে থাকে, আর শিকারিরা পলোর উপর দিকের খোলা অংশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছটি ধরে জালের থলি বা রশি দিয়ে কৌশলে আটকে কোমড়ে বেঁধে রাখে। পলো বাওয়া দলের পেছনে পেছনে কিছু লোক ছিপ জাল, ঠেলা জাল ও ঝাকি জাল (কোথাও কোথাও কইন্যা জাল/তৌওরা জাল বলা হয়) দিয়ে লাফালাফি করে পালিয়ে যওয়ার চেষ্টারত ছোট ছোট (পুঁটি, চাপিলা, লাঠি, চিংড়ি ইত্যাদি) মাছগুলো ধরে। পলো উৎসবটি অনুষ্ঠানের জন্য এলাকার (কয়েকটি গ্রাম বা উপজেলার লোক হতে পারে) পলো শিকারীরা প্রতিটি গ্রামের পলো শিকারীদের মুখে মুখে প্রচার করে পলো বাওয়া উৎসবের নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণ জানিয়ে দেয়। নির্ধারিত দিনে বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রামের পলো শিকারিরা নিজ নিজ পলো নিয়ে নির্দিষ্ট জলাশয়ে উপস্থিত হয় এবং ভাটি থেকে উজানের দিকে সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হয়। এসময় শিকারীরা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে ডাক ভাংতে থাকে। পলো ফেলার শব্দ ও মানুষের চিৎকারে পানিতে থাকা মাছগুলো আতঙ্কিত হয়ে লাফালাফি করলে মাছগুলো লক্ষ্য করে পলো দিয়ে সেগুলো আটকে ধরা হয়। পলো উৎসবে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের কেউ কেউ মাছ না পেয়ে খালি হতে বাড়ি ফিরে, আবার কেউ কেউ অনেকগুলো মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে। তবে সকলেই উৎসবে খুব অনন্দ করে। অসংখ্য লোক জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে পলো বাওয়া উৎসব উপভোগ করে। সাধারণত পেলো বাওয়ার মাধ্যমে বোয়াল, শোল, গজার, টাকি, রুই, কাতলা ও কার্প জাতীয় মাছ ধরা হয়। পলো বাওয়া উৎসবটি যেহেতু প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে অনুষ্ঠিত হয়, তাই এতে অংশগ্রহণের জন্য কোন ফি এবং প্রাপ্ত মাছের কোন অংশ কাউকে দিতে হয় না।  পোলো উৎসব ছাড়াও হয় মাছ ধরার বাওয়া উৎসব। শীতের আগমনে আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত হয় বাওয়া। মাছ ধরা যাদের নেশা ও পেশা, তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মাইকিং করে বাওয়ার দিন তারিখ ঘোষনা করে। হাজার হাজার মানুষ একযোগে মাছ ধরায় মেতে উঠে। পলো, জাল, জালি, শিপজাল, ফারেংগি জাল, চাক প্রভৃতি নিয়ে খাল, বিল, নদীতে নেমে পড়ে। আশে পাশে বাচ্চা, বুড়ো লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে মাছ শিকারিদের উৎসাহ দিতে থাকে। এভাবে সারিবদ্ধ ভাবে একযোগে মাছ ধরাকে বাওয়া বলে। কেউ যদি বড় চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা ধরতে পারে তবে আত্মিয়-স্বজন গ্রামবাসীদের সংগে ভাগাভাগি করে করে। মাছে-ভাতে বাঙালির জীবনে মাছ যখন হারিয়ে যেতে বসেছে তখন দেশের বিল আর হাওড় এলাকায় মাছ ধরা উৎসবের খবর অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতন। দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর-ডোবা, বিল-ঝিল থেকে শুরু করে হাওড়-বাঁওড় পর্যন্ত। এমন কি জলজ্যান্ত নদীও এই দখল প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। মাছের চলাচলের ব্যবস্থা না রেখেই তৈরি করা অপরিকল্পিত বাঁধ আর রাস্তা নির্মাণ একদিকে যেমন মাছের প্রাকৃতিক আবাসের বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করেছে অন্যদিকে বিলের মত জলাশয়ে মাছ চাষ প্রযুক্তির প্রসার বর্তমানে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের বৈচিত্র্যকে করছে কোণঠাসা। তবুও এক সময়ের বহুল প্রচলিত উৎসবটি এখনও যে একেবারে হারিয়ে যায় নি তাই বা কম কি! অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতিতে বিলে মাছ ধরা উৎসব অনেকের কাছেই মাছের জীব-বৈচিত্র্যের জন্য একটি হুমকি স্বরূপও মনে হতে পারে কিন্তু বাপ-দাদার সময় থেকে চলে আসা এই উৎসব নিশ্চিতভাবেই ততদিন চলবে যতদিন মাছ প্রাপ্তির খাতা শূন্য না হয়। এছাড়াও কাদা ছেচে মাছ ধরা আগেও ছিলো, এখনও আছে।

ভাদ্রমাসের তীব্র দাহে শুকিয়ে আশে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওরের পানি। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ওসব স্থানে অনেক মাছ আটকা পড়ে। তখন কাদা হাতড়ে চলে মাছ ধরা। তীব্র রোদে হাটু পর্যন্ত কাদাতে ডুবিয়ে মাছ ধরা বাঙ্গালির জীবনে এক বিনোদনই বটে।কাদাপানিতে মাখামাখি হয়ে ভুতুড়ে অবয়বে মাছ ধরেছি আমিও। কাদা বা পাকে বেশী ধরা পড়তো শিং, মাগুর, টাকি, কই, বাইম মাছ।  বয়স তখন বছর পাঁচেক, ঢাকার মনিপুরপাড়ায় এক সেঁচা পুকুরে ছেলে বুড়োর দলকে কাদা মেখে মাছ ধরতে দেখে মায়ের অগ্নিমুর্তি ভুলে সে দলে ভীড়ে গিয়ে যেই পাঁকে হাত দিয়েছি, অমনি বেয়াড়া শিঙি মাছ দিয়েছিল কাঁটা ফুটিয়ে। সে কী ব্যাথা! হাত ফুলে ঢোল। শিং মাগুরের কাঁটা ফুটলে কী ভয়ানক যন্ত্রনা হয় সেটা যার ফুঁটেছে সেই জানে! এ জন্যই কবি লিখেছেন, “ কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কি সে, কভু আশী বিষে দংশেনি যারে”! হাত ফুলে ন’মন ওজনের হয়ে গিয়েছিলো। আম্মা লোহার বটির আগায় চুন, হলুদ গরম করে ক্ষত-স্থানে লেপে দিলেন। এতে নাকি বিষ কমে। কিসের কী! মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকের মত চিলিক দিয়ে ব্যাথা মগজে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখিয়ে দিতো। আম্মা গজগজ করতেন, “ যাও! আরো কাঁদাপানিতে মাছ ধরো, আজ শিং ফুড়েছে, কাল শাপে কাটবে”! সেসব বাক্যি আমার কর্ণে ঢুকলেও মর্মে প্রবেশ করতোনা। বর্ষায় সড়ক পথে যাতায়াতের পথে পথের দুধারে থইথই পানি চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে ভেসাল জাল দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্যটি। ভেসাল জাল’ বইয়ের ভাষা হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘বেয়াল জাল’ নামে মানুষের কাছে অধিক পরিচিত। ভেসাল জাল ব্যবহারের মাধ্যমে একজন মানুষ খুব সহজে মাছ শিকার করতে পারেন। এর থলি বেশ বড়। খালের ব্যাসার্ধের উপর নির্ভর করে ভেসাল কত বড় হবে। জালের সামনের প্রান্ত খাল বা বিলের পানির গভীর ছুঁয়ে মাছকে থলিতে বন্দি করে। তখন জ দু’হাত দিয়ে জালে ঢুকে পড়া মাছগুলোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারেন। যার কারণে এ জালকে মাছ ধরার বিশেষ ফাঁদ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ভেসাল জাল দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা হয়। যেমন চিংড়ি, টেংরা, লইট্টা, পুঁটি, বাইলা, বাইমসহ নানান প্রজাতির মাছ। খাল-বিলে মাছ ধরার আরো অন্যান্য কৌশল থাকলেও এটি একটি স্থায়ী কৌশল। ভেসাল স্থায়ীভাবে নির্মাণ করার জন্য জেলেকে হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। জাল কেনা, ভেসাল তৈরি করার জন্য বাঁশ, রশি কিনতে হয়। তবে বর্ষা ঋতুতে জেলেরা কেবল এ ভেসাল দিয়ে মাছ ধরতে পারেন। শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিলে পানি না থাকায় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভেসাল জালে মাছ ধরার মাধ্যমে অনেক জেলের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে। সংসারে মাছের চাহিদা পূরণের পরেও ভেসালে ধরা পড়া মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন তারা। খালে সাধারণত জোয়ারের পর ভাটা পড়লে ভেসাল জাল পাতেন জেলেরা। এতে কম স্রোতে নদীর দিকে ফিরে যাওয়া মাছ জেলেদের জালে আটকা পড়ে। তবে ছোট মাছ ছাড়াও জেলেরা মাঝে মাঝে বড় বড় মাছও পেয়ে থাকে ভেসাল পেতে। যা গ্রাম-বাংলার অপরূপ গল্পের সাথে আমাদের পরিচয় করিযে দেয়। এছাড়াও ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরার উৎসব এখনও আমাদের দেশে টিকে আছে। ফাঁসজাল – গ্রামাঞ্চলের নদী, প্লাবনভূমি ও ধানক্ষেতে বহুল ব্যবহূত, পাতা হয় নদী ও বিলের স্বল্প বা গভীর পানিতে। এক ধরনের ফাঁসজাল দিয়ে কই মাছ ধরা হয় বলে তার নাম কইজাল।

ছাঁদন-জাল – এটিও এক ধরনের ফাঁসজাল। গোটা মাছ এতে জড়িয়ে যায়। বহুল আলোচিত কারেন্টজাল এ ধরনের ছাঁদন জালেরই একটি উদাহরণ। নানা আকারের একনালী সুতা দিয়ে তৈরি বলে মাছ জালের দিকে এগুতেই খুব সহজে তাতে জড়িয়ে পড়ে

গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে বন্যার সময় লোকে মাছ ধরার ফাঁদ পাতে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ফাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইকবর চাঁই, বেগা, ডুবা ফাঁদ, দারকি, উন্টা, তেপাই, ধীল, চেং, চাঁই, চান্দি বাইর, বানা, পলো, রাবনি, চারো ইত্যাদি। জাল আকার ও আকৃতি, ফোকরের আয়তন, পানিতে পাতার অবস্থান ও ব্যবহার পদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশে ব্যবহূত জালকে নানাভাবে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। ব্যাগজাল  – একটি কাঠামো দ্বারা খাড়া অবস্থায় খোলা থাকে এবং পানির স্রোতে অনুভূমিকভাবে প্রসারিত হয়। স্রোতের বিপরীতে পাতা হয়। বেহুন্দিজাল ও সাবাড়জাল বা আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট একই আকৃতির অন্যান্য জাল তলায় হাত দিয়ে টানা হয়। টানাজাল/ঠেলাজাল – ত্রিভুজ বাঁশের কাঠামোতে বাঁধা এই জাল ঠেলে ঠেলে বিল ও প্লাবনভূমিতে মাছ ধরার দৃশ্য বহু পুরাতন। স্থানীয় নাম ঠেলাজাল ও মইয়াজাল। বড় ছাঁকিজালও এক প্রকার টানাজাল। ভাসাজাল – অতি দীর্ঘ ও পাখাসদৃশ বিস্তৃত এবং মোটা রশিযুক্ত জাল। এ ধরনের জালের পার্শ্বভাগগুলি ও টানা রশি খুব লম্বা। বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের এই জালের স্থানীয় নাম বেড়জাল। এটি খুব বড় আকারের হলে জগৎবেড় বলে। মাছের আকারের উপর জালের ফোকরের আয়তন নির্ভর করে। ঝাঁকিজাল – বাংলাদেশের সর্বত্র ঝাঁকিজাল ব্যবহূত হয়। জাল ছোড়ার পর গোল দেখায়। জালের নিচের কিনারা জুড়ে লোহার বল গাঁথা থাকে বলে এটি ওজনে ভারি হয়। হাত দিয়ে ছুড়ে ব্যবহার করা এই জাল সাধারণত পুকুর, বিল, মোহনা ও উপকূলীয় অগভীর পানিতে ব্যবহূত হয়ে থাকে।

ধর্মজাল – সাধারণত চৌকো আকৃতির, আড়াআড়ি বাঁধা বাঁশের চারটি ফালির চার আগায় জালের চারকোণা বাঁধা থাকে। বাঁশের ফালির সংযোগস্থলে অন্য একটি বাঁশ বেঁধে এটিকে পানিতে ফেলা অথবা পানি থেকে উঠানোর জন্য লিভারের  মতো ব্যবহার করা হয়। জালটি হস্তচালিত ও সহজে বহনীয়। কখনও কখনও বড় আকারের জালও বানানো হয় এবং এটিকে পানির গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থায়ীভাবে বসানো হয়। এগুলি খড়াজাল ও কোনাঘরজাল নামে পরিচিত।

ফলিং নেট – মাছের আবাসস্থল ও মাছের আকারের ভিত্তিতে এই জাল বিভিন্ন আকার ও আকৃতির হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রধানত এক ধরনের জাল দেখা যায় যা ঝাঁকিজালেরই বড় সংস্করণ। স্থানীয় নাম ওথেড় জাল। এই জালের সুতা বেশ মোটা এবং ফোকর বড়, ব্যবহূত লোহার বলও ওজনে ভারি। এই জালে নদীর গভীর থেকে মাছ ধরা হয়। পাঁচ থেকে দশ জন লোক জালসহ সাঁতার কেটে নদীর নির্দিষ্ট জায়গায় জালটি পাতে। জেলেরা  কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাছ ধরার জন্য ডুব দিতে শুরু করে। অনেক সময় মাছ ধরে পাড়ে আনে বা জালেই পেঁচিয়ে রাখে এবং জাল না তোলা পর্যন্ত মাছ ওখানেই থাকে। এই ধরনের আরেকটি জালের স্থানীয় নাম ছবিজাল। অগভীর পানিতে ব্যবহূত। এই জাল নাইলনের সুতা ও রশি দিয়ে তৈরি। ভারি রশির সাহায্যে জালের মুখ আলগা রাখা হয়। জালটি মোচাকৃতির ও মোচার দড়ি দিয়ে বাঁধা। জাল পানিতে ফেললে মাছ জালের ভেতরে ঢাকা পড়ে যায় এবং তাতে আটকে পড়ে। চাকজালও এ ধরনের জাল, দেখতে ছবিজালের মতো। বাঁশের ফালির বেড়ে জালের মুখ বাঁধা থাকে। শীতকালে নদী ও বিলে চাকজাল পাতা হয়।

 

আব্বার মুখে উনার ছোটবেলার গল্প শুনতাম। ভাদ্র মাসে ভাগিরথী যখন ফুলে ফেঁপে উঠত, তখন বান আসত। সে বানের পানি বাড়ীর সামনে আসার বেশ আগেই সবাই জানতে পারত। খেত থেকে মুনিষ ছুটতে ছুটতে এসে খবর জানাত “ বান আইছছে গো”! পানির গুম গুম শব্দও নাকি কানে ভেসে আসত। বাড়ীর যুবক, ছেলে, বুড়ো সবাই কোঁচ, পোলো, ঝাঁকি জাল নিয়ে ছুটত। পানি পায়ের পাতা ডুবতে না ডুবতেই বড় বড় বোয়াল ধরা পড়ত। বর্ষার বোয়াল পুরো দিনের পোয়াতি শরীর নিয়ে বেশি নড়তে চড়তে পারত না বলেই সেগুলো বেশি ধরা পড়ত। মাঠ, ঘাট, ক্ষেত খামার সব পানিতে ডুবে যেত।  বাড়ীর সামনের বড় পুকুর ছাপিয়ে জল একাকার হয়ে যেতো। চলত মাছ ধরার পালা। বেশি পরিশ্রম না করেই প্রচুর মাছ ধরা যেত। জলমগ্ন ধান, পাটের গাছের নড়াচড়া দেখেই কোঁচ বিধিয়ে দিত বা পোলো চেপে ধরলেই বড় বড় বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল ধরা যেত। ছেলে, বুড়ো সবাই মাছ ধরতে গেলেও আব্বা যাওয়ার অনুমতি পেতেন না। বিধবা মায়ের সবেধন নীলমনি ওই একটি মাত্র পুত্র বলেই আদরের চেয়ে শাসনের মাত্রাটাই ছিলো বেশি। দোতলার জানালা দিয়ে আব্বার করুন চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকা দেখে হয়তো বলতেন, “ যাও, উঠোনে একটু পা ভিজিয়ে এসো”! ব্যাস! এটুকুতেই আব্বা খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠোনে নেমে যেতেন। বড় বড় চিংড়ি মাছের অবাধ বিচরন দেখে দিশেহারা হয়ে খপ করে দু-হাতে জাপটে ধরে একটি বিশাল চিংড়ি ধরে আপাদমস্তক ভিজে দোতলায় উঠে যেতেন। দাদী সে চিংড়ি ভেজে কাঁসার ফুলকাটা থালায় সাজিয়ে যখন আব্বার সামনে দিতেন তখন তা দেখেই আব্বার পেট ভরে যেত। পরে কলেজে উঠে যখন বহরমপুরে হোস্টেলে থাকতেন তখন যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়িয়েছেন। তখন ছুটির দিনে মাছ ধরতে যেতেন বন্ধু দিলিপদের সিঙ্গি পুকুরে। দিলিপ কাকুদের টাইটেল ছিলো সিংহ। তাই উনাদের পুকুরের নাম হয়েছিলো সিঙ্গিদের পুখর। মাছ ধরায় নিজে মোটেও চৌকস ছিলেননা। কিন্তু বন্ধুদের সাথে ছিপ ফেলে যে আনন্দ পেতেন সেটাই আব্বার জন্য অনেক বেশী ছিলো।

আমাদের বাসার সামনের পৌ্রসভার বিরাট পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হতো। বিশাল জাল নিয়ে অনেক লোক পুকুরে নেমে আস্তে আস্তে  পাড় ঘেষে পুরো পুকুরকে বেষ্টন করে জাল টেনে নিতো, অসংখ্য মাঝারি সাইজের মাছ লাফিয়ে জালের বেড়া ডিঙ্গিয়ে জলে পড়তো। ধীরে ধীরে জাল টেনে একদিকে আনা হতো। পাড়ে উৎসাহী মানুষজন, আমরা ছোটরাও থাকতাম প্রচুর। জাল টেনে বাঁধানো ঘাটের পাশে ঘাসের উপরে আনা হতো। সব মাছ ঘাসের উপর ঢেলে তারা আবার জাল নিয়ে পুকুরে নামতো। আরেক দল লোক ঢেলে রাখা মাছের স্তুপ থেকে মাছ আলাদা করে বড় বড় ঝুড়িতে রাখতো। বড়, মাঝারি, ছোট এভাবে ভাগ করা হতো। লাফিয়ে ঝাপিয়ে অনেক মাছ দূরে ছিটকে পড়তো। সুযোগ সন্ধানী কুঁচোকাচার দল সেগুলো চট করে কচুপাতায় মুড়িয়ে নিতো। অনেক সময় সে মাছের কিছু আমাদের বাড়িতেও আসতো। কারন আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন পৌ্র-পিতা।

একদিন ভোরে আব্বা ঐ পুকুরে গোসল করতে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আম্মাকে ডেকে নিলেন। ভোর ভোর বলে পুকুর ঘাট ফাঁকাই ছিলো। আব্বা আম্মা দুজনে মিলে ইয়া বড় এক রুই মাছ ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে এলেন। লালচে সে রুই এর তড়পানি, আর আব্বা, আম্মার উত্তেজিত গলায় আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ছুটে গেলাম পুকুর পারে। দেখি পুকুর জুড়ে বড় বড় রুই কাতলা ভেসে বেড়াচ্ছে। ছুটে গিয়ে আব্বাকে সংবাদ দিলাম যে আরো অসংখ্য মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আম্মা সাফ জানিয়ে দিলেন – না, আর একটাও আনা হবেনা। এতো মাছ কি করে রাখা যাবে? খাবেই বা কে? তখন তো আর ফ্রিজ ছিলোনা। ততক্ষনে সারা পাড়া ঝেটিয়ে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে মাছ ধরছে। অবাক কান্ড! মাছগুলোও যেন মানুষের হাতে নিজেকে তুলে দেবার অপেক্ষাতেই ছিলো। কোন বাদ-প্রতিবাদ ছাড়াই তারা ধরা দিচ্ছিলো। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পুরো পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে উঠলো। আমরা তো অবাক! এমন কান্ড আগে কখনোই দেখিনি। অনেকেই মুমুর্ষ মাছ তুলে নিতে লাগলো। পৌ্রসভার লোকেরা এসে বল্লো, – পুকুরে বিষ দেয়া হয়েছে। মরা মাছ যেন কেউ না খায়। সারা পুকুর জুড়ে পুঁটি, ট্যাংরা, মৌ্রলা, বাতাসী, চ্যালা সহ অসংখ্য ছোট মৃত মাছ ভেসে থাকলো। জাল ফেলে সেগুলো তুলে মাটিচাপা দেয়া হলেও অনেক মৃত মাছ রয়ে গেলো। কয়েক দিন পর্যন্ত পঁচা মাছের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ছিলো। তারপর পুকুরে প্রচুর চুন,  কলা গাছের কান্ড টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়া হলো পুকুরের পানি পরিস্কার করার জন্য।

ঝুম বর্ষার রাতে যখন পাশের মাঠটাতে পানি থই থই করতো, পুকুর ছাপিয়ে পানি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো, তখন পাড়ার অতি উৎসাহী যুবকেরা কোঁচ, পলো, টর্চ নিয়ে ঐ মাঠে মাছ ধরতে যেতো। কেউ কেউ গামছাও নিতো। তাদের আনন্দ-মুখর কলরব শুনে আমরা জানালা খুলে তাকিয়ে থাকতাম। মানুষগুলোর অবয়োব বোঝা না গেলেও তাদের হাতের টর্চের আলো আলেয়ার মত নেচে বেড়াতো। তারা কোঁচ দিয়ে কচু ঝোপের নিচে লুকিয়ে থাকা বোয়াল, রুই, কাতলা, কঁই মাছ ধরতো। পলোতে আঁটকেও ধরতো। আর গামছা দিয়ে ধরতো ক্ষুদে শোল, গজারের কালো কালো পোনার ঝাক। বর্ষায় টিপটিপ বৃষ্টি, মেঘের গর্জনে কঁই মাছ পুকুর থেকে উজিয়ে কানকোয় হেঁটে পাড়ের ঘাসের জমিনে উঠে আসতো। তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে! একজন একটা পেয়েই আনন্দে এমন হই-হুল্লোড় শুরু করে দিতো যে মুহুর্তে পাড়ার সব ছেলেমেয়ে জড়ো হয়ে কঁইমাছ পাওয়া হাতের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টি হেনে পুকুর পাড়ে একেবারে তন্নতন্ন করে খোঁজ শুরু করে দিতো। কঁই মাছের কাঁটার ভয়ে সে বয়সে আমরা সে মাছ পাতেই নিতাম না। কিন্তু খাওয়ার চেয়ে মাছ ধরার আনন্দই যে অনেক বড় ছিলো তখন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় হাট-বাজার যখন বন্ধ ছিলো, জনশুণ্য পাড়ার সেই পুকুরের মাছ আমাদের পাতের তৃপ্তি জুগিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সিলেটের বাড়ির সামনেও একটা পুকুর ছিলো। আর তা ছিলো আমাদের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে। আয়োতনে ছোট হলেও তাতে মাছ ছিলো প্রচুর। কিন্তু তখন আমার মাছ ধরার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেছে। ধিঙ্গি মেয়ে পুকুর পাড়ে ছিপ ফেলে বসে থাকবে, পাড়া-প্রতিবেশীরা ছেড়ে কথা কইবে কেন? তাও মাঝে মধ্যে ছুটির অলস দুপুরে মায়ের দীবানিদ্রার সুযোগে ভাঙা ইঁট বের করা ঘাটে গিয়ে বসে থেকেছি। ভাঙ্গা ঘাটলার ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে চিংড়ি লুকিয়ে থাকতো। সচ্ছ, কাঁচের মত সে চিংড়ি ধরে ছিপ না ফেলতে পারার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলেছি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান