স্বপ্ন পূরণ (উমরা৮)

ইসলামে ফজিলত লাভের উদ্দেশে্য তিন মসজিদে ভ্রমণ করার অনুমোদন আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম বা কাবা শরিফ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে জেরুজালেমের মসজিদ আল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস: ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদ। তৃতীয়টি হলো মদিনার মসজিদে নববি, মদিনা নবীর শহর, একে আরবিতে বলা হয় ‘মদিনাতুন নবী’। আর মদিনার প্রাণকেন্দ্র হলো ‘মসজিদে নববি’। মসজিদে নববির ভেতরে একটা জায়গা আছে, তার নাম রিয়াজুল জান্নাত। রিয়াজুল জান্নাত বলতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে তৈরি করা মসজিদকে বোঝায়। মিম্বর ও হুজরাহর মধ্যবর্তী স্থান। মসজিদে নববিতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক এবং তাঁর জমানার মূল মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানকে নবীজি বেহেশতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলেছেন। এটাই রিয়াজুল জান্নাত। এই জায়গায় সবুজ-সাদা রঙের কার্পেট বিছানো আছে। মসজিদের অন্য কার্পেটগুলো লাল রঙের। ভিন্ন রঙের কার্পেট দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না রিয়াজুল জান্নাতের সীমানা। এ স্থানে নামাজ পড়া অতি উত্তম।

রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান সম্পর্কে কয়েকটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ইবনে হাজাম (রা.) বলেন, রিয়াজুল জান্নাতকে জান্নাতের বাগান বলা হয়েছে রূপকভাবে। ওলামায়ে কেরামরা রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে, এখানে জিকির করলে রহমত ও সৌভাগ্য লাভ করা যায়। নুরুদ্দিন সামহুদির লেখা অফা আল অফার দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত, রিয়াজুল জান্নাতে ইবাদত বেহেশতের বাগানে পৌঁছায় এই অর্থে ও তা রূপক অর্থবোধক। আল্লাহ এই স্থানটুকু হুবহু বেহেশতে স্থানান্তর করবেন। এই অংশ অন্যান্য জমিনের মতো নয়। পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ রাখি। রিয়াজুল জান্নাতের ভেতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে, সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বলে। রাসুল (সা.)-এর তৈরি মসজিদে খেজুরগাছের খুঁটিগুলোর স্থানে উসমানি সুলতান আবদুল মাজিদ পাকা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্ণের কারুকাজ ।

নবী করিম(সাঃ) হিযরতের পর যখন মদিনাতে আসলেন তখন এই এলাকাটির সকলেই তার উটের রশি ধরে টানাটানি করতে থাকলেন, যেন তাদের বাসায় নবীজি অবস্থান করেন। নবীজি সবাইকে বললেন, ‘আমার উটের রশি ছেড়ে দাও এবং উটটি যে বাড়ীর সামনে বসবে আমি তারই মেহমান হবো।’ উটটি একটি বাসায় বসার পরে নবীজি তার মেহমান হলেন এবং পাশের দুই এতিম বালকের কাছ থেকে একটি জায়গা কিনে তিনি মসজিদ ও বসবাস করতে থাকলেন। ‘মসজিদে নববী’ পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মসজিদ হলেও এর ভিতরের এই অংশটুকুই  সেই নবীজির ক্রয় করা অংশ এবং তিনি এখানেই নামাজ পড়াতেন।

এর বাম পাশেই নবীজি শায়িত আছেন। বৃহৎ এই মসজিদের ভিতর জুড়ে লাল কার্পেট, আর শুধুমাত্র এই অংশে সবুজ কার্পেট। এই অংশে নামাজ পড়া মানে আপনি জান্নাতে বসে নামাজ পড়লেন। এই অংশের সোজা উপরেই হাসর হবে। পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দুই রাকাত নামাজ পড়তে এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন। দুই রাকাত নামাজের পড়া হলেই পুলিশ সড়িয়ে দেন। অনেকে সেখান পর্যন্ত যেতেও পারেনা। পুরুষেরা যে কোন সময় রেয়াজুল জান্নাতে যাবার সুযোগ পেলেও মহিলারা তা পাননা। মহিলাদের জন্য শুধু ফজর আর এশার নামাজের পর ঘন্টা দুয়েক সময় বেধে দেয়া আছে। তাই প্রচন্ড ভীড় হয়। সেখানে একেক দেশের একেকটি দলে ভাগ করে তারপর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। তাই প্রচণ্ড ভীড়ে মহিলারা প্রায়শই নিজেদের মেজাজ, পর্দা ঠিক রাখতে পারেন না। কিন্তু হুইলচেয়ারে যারা সেখানে যাবেন তাদের জন্য আলাদা পথ থাকলেও দেশ বিভক্তি নেই। লাইনে বসে দরুদ শরীফ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তৃষিত দুই চোখ সেই পবিত্র স্থান দেখবার জন্য আকুল হয়ে ছিলো। দীর্ঘ প্রায় এক ঘন্টা পর আল্লাহের অশেষ রহমতে সেই কাংখিত জায়গায় প্রবেশ করতে পেরেছি। আমার হুইলচেয়ারের পেছনে বসে মায়িশাও দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিয়েছিলো। মায়িশা বলছিলো, এখনই সে শান্তিমত নামাজ আদায় করতে পেরেছে। অন্য সময় নামাজে প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি, উচ্চকন্ঠে তার খারাপ লেগেছে। আমরা জানি নবী করিম (সাঃ) রওজা, আল্লাহের ঘরে আমাদের নিজেদের বিনীত থাকা উচিত। এটাই নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখেছি এক দল উচ্চকন্ঠে দরুদ শরীফ সংগীতের মত জোরে গাইছে, জায়গা নিয়ে ঝগড়া, বিবাদেও লিপ্ত হচ্ছে। যা কিনা হজ্ব, উমরার খেলাফ তো বটেই ইসলামেরও খেলাফ। আল্লাহ আমাদের সব্বাইকে হেদায়েত দান করুন। আমীন! ছুম্মা আমীন!  আনন্দ ভরা মন নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। মায়িশার জন্য খাস দিলে দোয়া করলাম। আজ এই জান্নাতের টুকরাতে নামাজ পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য আল্লাহ পাক যেন তাকে উত্তম প্রতিফল দান করেন। পরদিন বিকেলে আমাদের দেশে ফেরার ফ্লাইট। মদিনা থেকে দুবাই, ছয় ঘন্টা পর দুবাই থেকে ঢাকা। সকালে ইতু, হায়াত সহ সবাই কিছু কেনাকাটার জন্য বেরিয়ে গেলো। আমি হোটেলেই রয়ে গেলাম। ওদেরকে বলে দিলাম আমার জন্য খেজুর, জায়নামাজ, তসবি, দুই নাতনির জন্য দুটো পেন্ডেন্ট কেনার জন্য। জোহরের নামাজের পর আস্তে আস্তে আমরা এয়ারপোর্টে যাবার জন্য তৈরী হলাম। মনটা খুব খারাপ হলো। জীবনে আর কি আসা হবে এই পবিত্র মাটিতে? আমার কাছে মক্কার মাটি, মক্কার মানুষ অনেক রুক্ষ মনে হয়েছে। সেই তুলনায় মদিনার মাটি, মদিনার মানুষের ব্যবহার অনেক কোমল, নমনীয়। কোমল নাহলে কি মদিনার লোকেরা মক্কা থেকে বিতারিত নবীজী সহ সাহাবীদের আশ্রয় দেয়। এ কারনেই মদিনাকে বলা হয় সোনার মদিনা। এই মক্কা, মদিনার প্রতিটি ধুলিকনা, আকাশ, বাতাসে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেসব ফেলে আসা সত্যি অনেক কষ্টের। তবুও যেতে হবে, যেতে হয়। বিকেলে আমরা মদিনা এয়ারপোর্টে গেলাম। এয়ারপোর্টেই আমাদের জনপ্রতি পাঁচ লিটারের  জমজমের পবিত্র পানির গ্যালন দেয়া হলো। মদিনা থেকে দুবাই। দুবাইতে অপেক্ষমান ছয়টি ঘন্টা ছিলো অনেক কষ্টের। প্রচন্ড ঠান্ডা, ফোলা পা, জ্বর, কাশি নিয়ে বিপর্যস্ত আমি। অপেক্ষার পালা শেষে অবশেষে ঢাকার উদ্দদ্যেশ্যে যাত্রা। একেতো শরীর খারাপ, তার উপর এয়ার হোস্টেসের কাছে গরম পানি চেয়েছিলাম। সে বেচারা ভুল করে ঠান্ডা পানির গ্লাস ফেলে দিলো আমার কাপড়ে। ভেজা কাপড়েই থাকতে হলো বাকি রাস্তা। দশই জানুয়ারি ২০১৯ সকাল দশটায় এসে পৌঁছালাম ঢাকায়। তারপর প্রায় মাস দেড়েক মারাত্বক নিউমোনিয়া, আর্থারাইটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অচলাবস্তায় চিন্তা করি, আল্লাহ পাক আমাকে করুণা করেছিলেন বলেই আমি আল্লাহর পবিত্র ঘর, প্রিয় নবীর দববারে উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। আবারো যেন যেতে পারি এই দোয়াই করি। আর হায়াত, আমার এই ভাইটি যদি জোর না করতো তবে কি আমার যাওয়া হতো? উমরা করে আসার মাত্র আড়াই মাস পরেই আল্লাহ পাক আমার ছোট ভাইটিকে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। আজ এই লেখার প্রতিটি ছত্রে আমি ভাইকে স্মরন করেছি। আল্লাহ পাক যেন ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আমীন!

 

 

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান