স্বপ্ন পূরণ (উমরা৪)

সকালে নাস্তা করে আমরা তায়েফে যাবার জন্য তৈরী হলাম। গাড়ী এলো প্রায় দশটার দিকে। তিনটা গাড়িতে আমরা ১২ জন তায়েফের উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হলাম। তায়েফ মক্কা থেকে প্রায় ৯১ কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিমে।   মক্কার আধুনিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও দেখলাম, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। তার মধ্যে চড়ে বেড়াচ্ছে উট আর দুম্বা। গাছ বলতে শুধুই বাবলা গাছ আর কাঁটার ঝোপ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি। শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও ্পার্কের মত। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। যাওয়া, আসার দুটি আলাদা রাস্তা। রাস্তা দেখে শিলং এর রাস্তার কথা মনে হলো। কিন্তু শিলং এর রাস্তা অনেক সংকির্ণ। রাস্তার এক দিকে রুক্ষ পাথুরে পাহাড়, অন্য দিকে খাদ। একটু ফসকে গেলেই আর বাঁচার আশা নেই। একেক পাহাড়ের চেহারা একেক রকম। যতই তায়েফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই পাহাড়ের রঙ সবুজ থেকে সবুজ হয়ে উঠছিলো। আল্লাহের কি অসীম নেয়ামত। মাঝে মাঝে ক্যাবল কার চোখে পড়ছে, সেগুলো দিয়ে স্থানীয়রা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে আসা যাওয়া করে। মনে পড়লো – মক্কা বিজয়ের পর এই তায়েফে নবীজী পায়ে হেঁটে এসেছিলেন। তখন তো এমন পথ ছিলোনা। হেঁটে, কিংবা উটের পিঠে চড়েই এসব দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই। প্রথম দর্শনেই চোখ ছানাবড়া। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সড়কের পাশেই পার্ক, যেখানে সবুজের সমারোহ। প্রশস্ত রাস্তার ধারে রং-বেরঙ্গের ফুল ঝলমল করছে। আমাদের গাড়ী হযরত আবদুল্লা ইবনে আব্বাস মসজিদের সামনে থামলো। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই আরেক চমক। হুহু শিতল বাতাস যেন আমাদের স্বাগত জানালো। আমরা জোহরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের ভেতরে গেলাম। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। এর পাশেই প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: চির শায়িত অছেন।এখানেই উনার বাসস্থান ছিলো। সেই বাসস্থানেই উনার কবর ও মসজিদ। মেয়েদের নামাজের আলাদা জায়গায় আমরা নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে বাইরের বেরিয়ে দেখি অনেক নারী, পুরুষ অল্প পরিমানে নানান পশরা সাজিয়ে বসেছে। আপেল, আঙ্গুর, কমলা, নাসপাতি,তাজা আলুবোখারা । জায়নামাজ, তসবি, আল্লাহের কালাম লেখা ওয়াল হ্যাংগিং। এক মহিলা বস্তা ভরে তুলশি পাতার গোছা এনেছিলো। নিমিষেই তার বস্তা খালি হয়ে গেলো। সবাই দেখি গোছা গোছা সেই তুলশি কিনে নিলো। আমরা খাবারের সন্ধানে যেতে নজরে পড়লো বাংলায় লেখা ‘ সোনার বাংলা হোটেল!  সমুদ্র পৃষ্ট থেকে এতো উচ্চতায়ও মাছের কারি, মাছ ভাজা দেখে ভাল লাগলো। খাওয়া দাওয়া শেষে সামনের পাবলিক ওয়াস রুমে হাত মুখ ধুয়ে ওজু করে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। একে একে দেখলাম হজরত আলী রা: মসজিদ। শত শত বছর আগের নীর্মাণশৈলী মনকে ভাবুক করে তোলে। তারপর দেখলাম মসজিদে আদম। আঙ্গুরের বাগানের পাশেই মসজিদটি। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে প্রথমবার তায়েফ আসেন তখন তায়েফবাসী নবীজীকে পাথর ছুড়ে রক্তাত্ত করে। তখন এই আঙ্গুর বাগানে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তায়েফবাসীদের জন্য, তায়েফের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। তায়েফ শহরের দু’টি স্থান রাসূল (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত। এর একটি হলো- যেখানে রাসূল (সা.)-কে পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে স্থানটি তারের বেড়া দিয়ে আবৃত। এ স্থানটির মধ্যে একটি কূপ রয়েছে। অপর যে স্থানে রাসূল সা:-এর পদধুলি পড়েছিল, প্রাচীনকালে নির্মিত একটি মসজিদ রয়েছে।

 

এরপর কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি পাথর দিয়ে ঘেরা। যদিও এই বুড়ির অস্তিত্ত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে,  তার পাশেই বড় বড় দু’টি পাথর। ছোট্ট পাথর দ্বারা আটকে আছে। হুজুর সা:-কে হত্যার উদ্দেশ্যে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো তায়েফবাসী ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়। যা আজো সেভাবেই রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে  রয়েছে হুজুর সা: মসজিদ।  দু’পাশে সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত আর নানা আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। আবহাওয়া তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মক্কা-মদিনার পর তায়েফ পবিত্রতার গুরুত্বের দিক থেকে তৃতীয়। এর মাটিতে নানান ধরনের ফসলসহ সুস্বাদু সব ফলের আবাদ হয়। বিভিন্ন ফুলের মধ্যে গোলাপও বেশ চাষাবাদ হয়। গোলাপজল তৈরিতে তায়েফের গোলাপের বেশ খ্যাতি রয়েছে। মরুভূমির লোহিত সাগরের কাছের শুষ্ক ও অনুর্বর অঞ্চলের আবহাওয়া থেকে তায়েফের আবহাওয়া ভিন্নতর। দীর্ঘকাল ধরে তায়েফ গম ও আঙুরসহ ফলমূল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। বর্তমানে তায়েফে বিভিন্ন ফলের পাশাপাশি ফুলের চাষ হয়। সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি সদস্যসহ সৌদি আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তি সবার তায়েফে ফলের ব্যক্তিগত বাগান রয়েছে। এসব বাগান থেকে পরিবারগুলোর বার্ষিক ফলের জোগান আসে।এপ্রিল মাসে তায়েফের গোলাপ বাগানগুলো প্রস্ফুটিত গোলাপে পূর্ণ থাকে। গাছ থেকে গোলাপ সকালে তোলা হয়। এসব গোলাপ তায়েফের বিখ্যাত গোলাপ তেল ও সুগন্ধি প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়। তায়েফের আঞ্চলিক জাদুঘর উনিশ শতকে নির্মিত শুব্রা প্রাসাদে অবস্থিত। ১৯৩০ সালে এ প্রাসাদটি বাদশা আব্দুল আজিজের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার হয়। তায়েফের ৪০ কিলোমিটার উত্তরে পাথরের ওপর খোদাই করা স্থানটির অবস্থান রয়েছে। তায়েফ শহরের ৩০ কিলোমিটার পূর্বে একটি বিমানবন্দর রয়েছে। এ বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের গন্তব্যে বিমান চলাচল করে। সৌদি আরবের বাদশা গ্রীষ্মকালে তায়েফ আগমন করে থাকেন এবং তথাকার শুব্রা প্রাসাদে অবস্থান করেন। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা আবদুল আজিজ এবং পরবর্তী বাদশা ফয়সাল উভয়ে তায়েফ অবস্থানের সময় এ প্রাসাদটিতে আনন্দঘন পরিবেশে দিন যাপন করতেন। তায়েফ থেকে ফেরার পথে একটি মসজিদে আমরা আসরের নামাজ আদায় করলাম। পুরুষেরা উমরার নিয়তে এহরাম পরে নিলো। ফিরে এলাম মক্কায়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান