স্বপ্ন পূরণ ( উমরা ২)

দুপুর ১২টার দিকে আমরা জোহরের নামাজের জন্য বের হলাম। হোটেলের আশেপাশে বেশ কিছু খাবারের দোকান আছে। সেখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে সিড়িতে বসে খেয়ে নিলাম। সকাল ১১টা থেকে হারাম শরীফের আশেপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। নামাজের সময় এই রাস্তায় কোন গাড়ি চলতে পারেনা। হারাম শরীফের বাইরে প্রচুর মানুষ বসে খাওয়া-দাওয়া করছে, কেউ কেউ শুয়েও আছে। গাট্টি-বোচকা নিয়ে কেউ কেউ সেখানেই রাত কাটায়। হারাম শরীফে প্রবেশের অনেকগুলো দরজা বা মূল ফটক রয়েছে। একেক ফটকের একেক নাম ও নম্বর লেখা আছে। কিং আব্দুল আজীজ ফটকের সামনে গিয়ে স্যান্ডেল খুলে পিঠের ব্যাগে রেখে মায়িশার হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ! মানুষের ঢল নেমেছে। অনেক আগে থেকেই সবাই জায়গা পাবার আশায় মসজিদে অবস্থান নেন। নামাজের সময় হারাম শরীফের সামনের চত্বর ছাড়াও রাস্তাতেও জামাতের কাতার হয়। এখানে মেয়েদের আলাদা জায়গা বরাদ্দ আছে। অনেক ঘুরে ঘুরে একটু জায়গা পেয়ে আমরা নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। জীবনের প্রথম মসজিদে নামাজ পড়া। আশে পাশে অনেকেই দেখলাম চেয়ারে বসে নামাজের প্রস্ততি নিচ্ছেন। ছোট, হালকা রটআয়রনের হালকা চেয়ার। ভাবলাম, হয়তো চেয়ার কিনে সঙে নিয়ে এসেছে। যেহেতু আমি চেয়ার আনিনি, তাই বসেই নামাজ আদায় করলাম। শুধু ফরজ নামাজ ইমাম সাহেব ইকামত দিয়ে পড়ান। সুন্নত নামাজ নিজেই আদায় করতে হয়। প্রতি ওক্তের নামাজের শেষে জানাজা পড়ানো হতে দেখেছি। জোহরের নামাজ পড়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আগামীকাল জুম্মাবার। সারাদিন হারাম শরীফে কাটানোর ইচ্ছা, তাই আজ বিকেলে মক্কা শহরটা ঘুরে দেখতে চাই। হোটেল মিলেনিয়ামের আগের নাম ছিলো হিলটন। যে স্থানে হোটেল মিলেনিয়াম গড়ে উঠেছে সেখানেই আগে হযরত আবু-বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বাড়ী ছিলো। এখন হোটেলের তৃতীয়তলায় আবু-বকর (রাঃ) নামে মসজিদ করেছে। কাবা চত্বরের আশেপাশের পুরনো স্থাপনা ভেঙ্গে বহুতল ভবনে পাঁচতারা হোটেল তৈরী করা হয়েছে। যা আমার মোটেও ভাল লাগেনি। আবু জেহেলের বাড়ীর স্থানে ঘৃনার পরিচয় দিয়ে পাবলিক টয়লেট তৈরী করা হয়েছে। শুধু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জন্মস্থানে একটি দোতলা ভবন আছে, যেটা একটি লাইব্রেরী রুপে আছে। আমরা হারাম শরীফের পাশ দিয়ে এস্কেলটরে নিচে নেমে বাস স্টপে গেলাম। যেহেতু রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ, তাই অধিকাংশ গাড়ীই এই আন্ডারগ্রাউন্ড বাস স্টপে এসে থামছে। আমরা একটা মাঝারি বাসে উঠে বসলাম। গাড়ি চল্লো মক্কা শহরের মধ্য দিয়ে। মক্কা-নামের মাঝেই অন্যরকম এক বিশুদ্ধতা। সৌদি আরবের হেজাজের একটি শহর মক্কা। মুসলিম জাতীর শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা) এর জন্মভূমি। ইসলামের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস ও হুজুর (সা) অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই নগরকে ঘিরে। রয়েছে কুরাইশ বংশধরদের আভিজাত্য, আবু জাহেলের অত্যাচারের করুণ চিত্র। মহানবী (সা) ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হয়ে এই মক্কা হতেই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিযরত করে মদিনা গিয়েছিলেন।২০১২ সালের হিসাব অনুসারে মক্কায় ২ মিলিয়ন মানুষের বসতি। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এই শহরের উচ্চতা ৯০৯ ফুট। আধুনিক মক্কা শহর এখন আরও নান্দনিক। প্রশস্ত সড়ক, নয়নাভিরাম সব স্থাপত্য পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। বাড়তি সৌন্দর্য প্রাকৃতিক নিদর্শন শত শত পাহাড় তো রয়েছেই। পুরো শহরটাই পাহাড় বেষ্টিত। অনেক জায়গাতেই দেখলাম পাহাড় কাটা হচ্ছে। রুক্ষ পরিবেশ।  সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আসমানি কিতাব কোরান শরীফের আয়াত এই শহরের জাবালে নূর পাহাড়ে প্রথম নাজিল হয়েছিল। জাবালে নূরের অর্থ আলোর পাহাড়। ওহি নাজিল হওয়ার আগে যখন হুজুর (সা) জাবালে নূর পাহাড়ে ধ্যানে বসতেন তখন তাঁর বিবি খাদিযা (রা) প্রতিদিন তিন বেলা করে, সেই উঁচু পাহাড়ে উঠে খাবার দিয়ে আসতেন। যা এ যুগের নারীদের জন্য অনুপম শিক্ষণীয় বিষয়।সেই জাবালে নুর দেখলাম।   বায়তুল্লাহর আরেক পাশে একখ- জমি, তাইসির যাবার পথে পড়ে। এখনও তা অন্ধকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের করুণ স্মৃতির সাক্ষী। এখানেই জীবন্ত কন্যাশিশু পুঁতে ফেলা হতো। উড়াল সড়ক হতে জায়গাটা বেশ ভালভাবে দেখা যায়। ইসলামের সুমহান বাণী সেই অন্ধকার হতে, মানুষকে আলোকিত করেছে। নারীদের দেয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। শহরের মধ্যভাগে রয়েছে মক্কা মিউজিয়াম। সেখানে রক্ষিত রয়েছে আদি কাবা ঘরের নমুনা, জমজম কূপের পূর্বেকার নিদর্শন ও যন্ত্রপাতিসহ নানা দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার প্রতিকৃতি। মিউজিয়ামের পাশেই কাবা ঘরের গিলাপ তৈরির কারখানা। আরেকটু আগালেই পড়বে, যেখান থেকে জমজম পানি মদিনা এবং বিভিন্ন দেশ হতে আগত হাজীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় জারে করে সাপ্লাই দেয়া হয়। যিয়ারা করার জন্য হাজীরা মক্কার জান্নাতুল মাওয়া গিয়ে থাকেন। যেখানে হাজার হাজার সাহাবিসহ মহানবী হুজুর (সা) প্রথম বিবি খাদিজা (রা) সমাধি রয়েছে। ইতিহাসের আরেক সাক্ষী সাফা ও মারওয়া পাহাড়। যে দুই পাহাড় ঘিরে হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর বিবি হাজেরা (আ) এবং তাঁদের পুত্র ইসমাঈল (আ) এর জীবনী রয়েছে। আল্লাহর দরবারে বিবি হাজেরা (আ) তৃষ্ণার্ত শিশু পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) জন্য পানি পান করানোর জন্য দোয়া করলে, আল্লাহ পাকের নির্দেশে জিব্রাইল (আ) পায়ের গোঁড়ালির মাধ্যমে কূপ খনন করেন। সে সময় থেকেই সৃষ্টি জমজম পানির কূয়া। পবিত্র কাবা ঘর হতে জমজম কূপের দূরত্ব মাত্র ৩৮ গজ। বর্তমানে সাফা-মারওয়া পাথুরে পাহাড় দুটো কেটে ছেঁটে কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। তবে এর গুরুত্ব অসীম। হজ ও ওমরাহ পালন করতে হলে এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাহী করতে হয়। সীমানা বৃদ্ধি করায় সাফা-মারওয়া এখন হারাম শরিফের মক্কা মসজিদের ভেতরেই পড়েছে। ঐতিহাসিক জমজমের কূপ এখন আর উন্মুক্ত নয়। তবে এর পানি পানের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। জমজমের পানি পান বিশেষ বরকতময়। যেসব হাজীরা ও ভ্রমণপিপাসুরা এর গুরুত্ব জানেন তাঁরা তৃপ্তিসহকারে পান করেন এবং সঙ্গে করে নিয়েও যান। জমজমের পানি রোগীদের জন্য বিশেষ শিফা। যা পরম করুণাময়ের দেয়া বিশেষ নেয়ামত। জমজম পানির বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষিত। পবিত্র হারাম শরিফের সামনেই রয়েছে কবুতরের মাঠ নামক একটি জায়গা। কিন্তু ওটা কোন মাঠ নয়, চলাচলের প্রশস্ত সড়ক। সম্ভবত বাংলাদেশীরাই এর নামকরণ করেছে। সেখানে রয়েছে হাজার হাজার জালালি কবুতর। খুবই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। আগত বহু দর্শনার্থী নিজ খরচে খাবার কিনে অবিরাম বিলিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, চলে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতরের আনাগোনা। এক কথায় অসাধারণ সব মুহূর্ত। মক্কাতেই রয়েছে জাবালে ছাওর পর্বত। হুজুর (সা), হযরত আবুবকর (রা) নিয়ে মদিনা মুনওয়ারায় হিজরতের সময় এই পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। বর্তমানে সেখানে পর্যটকদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে, ছাওর পর্বতের দৃশ্যাবলী দেখানো হয়।মক্কা, মদিনায় ধর্মীয় রীতি পরিপন্থি কোনো কিছু করতে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে কঠিনভাবে বারণকরা হয়। তারপরও কাউকে কাউকে দেখা যায়, সেখানে অতি আবেগি কর্মকাণ্ড ঘটাতে। আর এসব কাজ বেশিরভাগ করেন, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা হাজিরা। তেমনি একটি ঐতিহাসিক স্থান জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড়। এর অবস্থান মক্কার পূর্ব দিকে মসজিদে হারাম থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে। শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ(সা.) এখানে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। পাহাড়টি গ্রানাইড পাথরে গঠিত, উচ্চতা প্রায় ৭০ মিটার। এই পাহাড়ের চতুর্দিকে দৈঘ্য-প্রস্থে দুই মাইল সমতল ভূমিকে আরাফাতের ময়দান বলা হয়। অবশ্য আরাফাতের পাহাড়ের মাধ্যমে সমগ্র এলাকাকে বোঝানো হয়। হজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে এই স্থান মুসলমানদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।এই পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে মনটা ভীষন

আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। বার বার নবীজীর বিদায় হজ্বে বানী মনে পড়ছিলো। আরাফাতের ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। ময়দানের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড। এই সড়কের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে প্রায় এক কিলোমিটার। সেখান থেকে দক্ষিণে মসজিদে নামিরায় গিয়ে আরাফাত সীমান্ত শেষহয়েছে। জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রহমত হলো- রহমতের পাহাড়। এই পাহাড়ের ওপর একটি উঁচু পিলার আছে। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলেন। এছাড়া আরও বেশ কিছু নাম রয়েছে পাহাড়টির। ওপরের পিলারের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি আছে। পাথরের সিড়িগুলো বেশ প্রশস্ত। পাহাড়ের ওপরটা মোটামুটি সমতল। তবে পাহাড়ের ওপরের পিলারে লেখা আছে, ওই পাহাড়ে উঠে কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না। নির্দেশনায় কয়েকটি ভাষার মাঝে বাংলা ভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে।

সৌদি সরকারের নিয়োজিত পুলিশ দর্শনার্থীদের এসব মনে করিয়ে দিতে সদা তৎপর। যেমন বলা আছে, আপনি এই স্তম্ভের দিকে ফিরে নামাজ পড়বেন না, দোয়া করবেন না, পিলার ধরে চুমু খাওয়া যাবে না। নামাজ পড়তে হলে কিংবা দোয়া করতে হলে একমাত্র কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে হবে। তার পরও দর্শনার্থীরা কম যান না, পাহাড়ের গায়ে আরবী, ইংরেজি, উর্দু ও বাংলায় অনেক কিছু লিখে রেখেছে। এমনকি অনেককে দেখা গেলো, কলম নিয়ে গেছেন- সেখানে মনের কথা লিখে রাখার জন্য। যারা কলম নেননি, তারা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রচণ্ড রোদে বসে মনের কথা লিখে রাখছেন। পাহাড়ের পাদদেশে একটি সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ভাষায় পাহাড়ের নাম লেখা আছে, তন্মধ্যে বাংলা ভাষায় লেখা আছে- রহমতের পাহাড়। প্রচুর পাকিস্তানিকে দেখা গেলো- তসবিহ, আংটি, কলম ইত্যাদির পাসরা সাজিয়ে বসে আছেন। বোরকাবৃত কিছু নারী ‘সাদাকা লিল্লাহি’ বলে ভিক্ষা চাইছেন, আর বাচ্চারা চাইছে, ‘ইয়াল্লা বাবা হাজি’ বলে। লোকজন দানও করছে প্রচুর।

মক্কা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাতায়াতের জন্য একাধিক রাস্তা আছে। বাসের পাশাপাশি ট্রেনও আছে। তবে ট্রেন শুধু হজের কয়েকদিন যাত্রী সেবা দেয়। অন্য সময় বন্ধ থাকে।আরাফাতের ময়দানজুড়ে রয়েছে সারি সারি নিমগাছ। আরবি ড্রাইভার আমাদের জানালেন, এসব গাছ নাকি বাংলাদেশ থেকে এনে রোপণ করা হয়েছে।বলা হয়, জাবালে রহমতের এই স্থানে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর সাক্ষাত হয়েছিলো। কিন্তু এর পক্ষে কোনো শক্তিশালী প্রমাণাদি মেলে না। আরাফাতের ময়দানে আদম-হাওয়ার সাক্ষাতস্থল হিসেবে কোনো স্থান নির্ধারিত নেই এবং এমন কোনো বিষয় প্রমাণিতও নয়।হজের সময় যে প্রান্তর থাকে লোকে লোকারণ্য, বছরের অন্য সময় সেগুলোতে ভিড় করে ওমরাহে আগত নানা দেশের পুণ্যার্থীরা। হজের সময় ভালো করে দেখার ফুসরত পাওয়া যায় না বলে অন্য সময় মানুষ ঘুরে ফিরে দেখে স্মৃতিময় এলাকাগুলো। আরাফাতের ময়দানের শীর্ষে ‘জাবালে রহমত’ বা ‘করুণার পাহাড়’, যেখানে হজের নির্দিষ্ট দিনটিতে দোয়া কবুল হয়।

তবে হ্যাঁ, আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতের পাহাড়ে স্থাপিত সাদা রংয়ের ছোট পিলারটি জাবালে রহমতকে চিহ্নিত করার জন্য স্থাপিত। যেহেতু আরাফাতে সবদিকেই পাহাড়, এর মধ্যে কোন পাহাড়টা জাবালে রহমত, যার পাদদেশে হজরত রাসূলে কারিম (সা.) বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন, তা যেন লোকেরা সহজে চিনতে পারেন এজন্য এই চিহ্ন সেখানে স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষাধিক সাহাবির উপস্থিতিতে বিদায় হজের ভাষণ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কসওয়া নামক উটে আরোহণ অবস্থায় দিযেছিলেন। ওই উটের পীঠে অবস্থানকালীন সময় কোরআনের আয়াত নাজিল হয়, ‘আজ তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকে তোমাদের ওপর যথেষ্ট করে দিলাম, আর আমি ইসলাম ধর্মের ওপর সন্তুষ্ট।’

মক্কা শরিফ থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম জাবালে নূর। এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গুহাকে বলা হয়- ‘গারে হেরা’ বা ‘হেরা গুহা’। নবুওয়ত লাভের পূর্বে নবী করিম (সা.) এই গুহায় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এখানেই সর্বপ্রথম অহি নাজিল হয়েছিলো। নিচ থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়টি খুব বেশি উঁচু নয়। কিন্তু আদতে পাহাড়টি বেশ উঁচু। এমনকি জাবালে নূরে যাওয়ার জন্য যেখানে গাড়ি দাঁড়ায়, সেই স্থানটিও সমতল থেকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ফুট ওপরে। সমতল থেকে এটুকু পথ গাড়িতে ওঠা যায়। কেউ অবশ্য এটুকু হেঁটে ওঠেন। আবার কেউ গাড়ি নিয়ে ওঠেন। মূল পাহাড়ের উচ্চতা ৫৬৫ মিটার। এখানে উঠতে হয় হেঁটে।

অনেক দশনার্থী পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন। তীব্র গরম, রোদের তাপ আর সঙ্গীদের নিরুৎসাহ ইত্যাদি মিলিয়ে আমাদের অবশ্য ওপরে উঠার সাহস হলো না। যদিও ওপরে উঠার রাস্তা কোনো রকমে পাথর কেটে কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পাইপ বা চিকন রডের রেলিং দেওয়া আছে। অগত্য জাবালে নূর দর্শন হলো- পাহাড়ের গোঁড়া থেকে।

যারা উঠেছেন, তাদের ভাষ্য হলো- এখন ওপরে ওঠা আগের তুলনায় অনেক সহজ। কিছু দূর উঠে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। পথে এ রকম পাঁচটি বিশ্রামাগার রয়েছে।

ভাবতে অবাক হতে হয়, আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে জাবালে নূরের একেবারে চূড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় উঠার জন্য এখনকার মতো রাস্তা ছিলো না। কোনো সিঁড়ি ছিলো না। ছিলো না কোনো রেলিং। তখন এই পথ বেয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ওপরে উঠতেন। আর উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য নিয়ম করে খাবার নিয়ে যেতেন!

যে গুহায় নবী করিম (সা.) নবুওয়তের আগে ধ্যান করতেন এবং যেখানে কোরআন নাজিল হওয়া শুরু হয়, ওই গুহাটির আয়তন ৬ থেকে ৭ বগফুট। দশনার্থীরা এখানে এসে নামাজ পড়েন। চেষ্টা করেন কিছু সময় ধ্যান করার। ইতিহাসে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালার অদৃশ্য ইশারায় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর এখানে মাসখানেক গভীর ধ্যান ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকতেন। নিঝুম গবেষণা, একনিষ্ঠ ধ্যান ও নির্জনতা অবলম্বনের যথার্থ পরিবেশ বিরাজমান ছিল এ গুহায়। নবী করিম (সা.)-এর বয়স চল্লিশে পৌঁছার অনেক আগে থেকেই তিনি এখানে নির্দিষ্ট মেয়াদে সময় কাটাতে থাকেন। হজরত খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের পর থেকে প্রতি বছরই তিনি রমজানের একমাস এখানে নির্জনবাস করতেন। এরূপ নির্জনবাস কোরায়েশরাও জাহিলি যুগে করতো।

নবী করিম (সা.)-এর বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলে তার প্রতি অহি নাজিল হয়। নবী করিম (সা.)-এর গারে হেরায় নির্জন বাস বিষয়ে কোরায়েশরা তার সঙ্গে দুশমনি করেনি। কারণ তার পিতামহ আবদুল মুত্তালিবই সর্বপ্রথম এখানে নির্জনবাস করেছেন এবং তিনি এ প্রথার সূচনা করেছেন। বর্বরতার তিমির পরিবেশে কেউ পাপমুক্তি ও পরিশুদ্ধি অর্জন করতে চাইলে তার সংশোধনাগার ছিল এ গারে হেরা।

মূলত এখানে নির্জনবাসের কারণ ছিলো- পাপ বর্জন করা, সব ধরনের অন্যায় থেকে দূরে থাকা, একত্ববাদের আদর্শে অটুট থাকা, মূর্তিপূজা পরিহার করে পূণ্য কাজে মনোনিবেশ করা। নির্জনতা অবলম্বন করে ধ্যান-গবেষণা করা, নিভৃতে সাধনা সংযম করা।

নবী মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতির শান্তির জন্য, মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। তিনি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর উপলব্ধি জাগানো এবং মানুষকে কুফর ও শিরক হতে মুক্ত করার ভাবনায় নিমগ্ন থাকতেন সদা সর্বদা। নিজ বাসস্থান থেকে অনেক দূরে হেরা গুহায় একাকী নিজনে থাকা তারই একটি প্রক্রিয়া।

হেরা গুহা ও জাবালে নূর এ দু’টি স্থান ও মুসলমানদের কাছে খুবই প্রিয়। এই পাহাড়ের হেরা গুহায় প্রথম অহি নিয়ে আসেন হজরত জিবরাইল (আ.)। তিনি এসে নবী করিম (সা.) কে বলেন, ‘পড়ুন।’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’ হজরত জিবরাঈল (আ.) নবী করিম (সা.) কে আলিঙ্গন করলেন। জিবরাঈল (আ.) পুনরায় তাকে বললেন, পড়ুন। এভাবে তিন বার ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাকে আলিঙ্গন করেন। এরপর নবী করিম (সা.) পড়তে শুরু করলেন। প্রথমে হজরত জিবরাঈল (আ.) সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ে শোনান। এভাবেই সূরা আলাক নাজিলের মধ্য দিয়ে শুরু কোরআন নাজিল। সূচনা হয় নতুন ধর্ম- ইসলামের।

বস্তুত হেরা গুহা বা গারে হেরা ইসলামের ইতিহাসে একটি আলোচিত জায়গার নাম। ইসলামের ঐতিহাসিক নির্দেশনাবলীর অন্যতম। মানব জাতির মুক্তির দিক নির্দেশনা সম্বলিত গ্রন্থ এবং প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেজা সব শেষ ও সেরা আসমানি কিতাব কোরআনে কারিম দুনিয়ার বুকে সর্ব প্রথম এখানে নাজিল হয় যে কারণে এই গুহার মূল্যায়ন এতো বেশি।

 

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান